ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে বিএনপি আয়োজিত সেমিনারে আলোচকেরা এই আইনকে একটি ‘কালো’ আইন বলে বর্ণনা করেছেন। এর ব্যাখ্যায় আলোচকদের কেউ কেউ বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কোনো আইন নয়, এটি একটি অস্ত্র। তাঁরা অভিযোগ করেন, ভিন্নমত দমনে এই অস্ত্রের ব্যবহার বেড়েছে। কেউ কেউ বলেন, নির্বাচন সামনে রেখে যেন কেউ ক্ষমতাসীনদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে না পারে, এমন চিন্তা থেকে এই নিপীড়নমূলক আইন ব্যবহার করা হচ্ছে।
বিএনপির সেমিনার থেকে আইনটির সংশোধন বা সংস্কার নয়, এটি বাতিলের দাবি করা হয়েছে।
আজ মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, গণতন্ত্র এবং সাংবিধানিক কাঠামো’ শীর্ষক এই সেমিনারের আয়োজন করেছিল বিএনপি। সেমিনারে বিএনপি ও সরকারবিরোধী আন্দোলনে থাকা অন্য দলগুলোর নেতারা আলোচনায় অংশ নেন। এ ছাড়া বিরোধী দল এবং তাদের সমর্থক পেশাজীবী সংগঠনগুলোর নেতা–কর্মীদের যাঁরা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের শিকার হয়েছেন বা ভুক্তভোগী, তাঁদেরও অনেকে আলোচনায় অংশ নিয়ে নিজেদের ঘটনা তুলে ধরেন।
সেমিনারে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, নির্বাচন সামনে রেখে কেউ যেন সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে না পারে, কেউ যেন তাদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে না পারে এবং নির্বাচনে তাদের কেউ যেন বাধা দিতে না পারে, সে জন্য এ ধরনের কালো আইন করে তা ব্যবহার করছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ব্যবহার করে সাংবাদিকদের মধ্যে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন মির্জা ফখরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘এমন একটা পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে, যে পরিবেশে নাগরিকেরা তাদের অধিকার বা অভিযোগ নিয়ে কথা বলতে ভয় পাচ্ছে। সাংবাদিকেরাও যেন না লেখেন, সেই ব্যবস্থাও করা হচ্ছে।
বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘সকল কালাকানুন বাতিল করতে হবে। সবার আগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করতে হবে। এটা এখন দেশের দাবি, জনগণের দাবি।’
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ব্যবহার করে নাগরিকদের নির্যাতন করা হচ্ছে অভিযোগ করে বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘জার্মানির গণমাধ্যম ডয়চে ভেলের একটা ভিডিও গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে র্যাবের নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে। সেই ভিডিওতে নাফিজ নামের একজন সাক্ষ্য দিয়েছিল, তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সরকারের একটাই লক্ষ্য—নাগরিকদের কথা বলতে দেওয়া হবে না, নাগরিকদের তাদের অধিকার প্রয়োগ করতে দেওয়া হবে না। তারা তাদের মতো করে এখনো রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়, করেছে সেভাবে।’
মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের একমাত্র পথ—এদের (ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ) সরাতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।
বিএনপি মহাসচিব অভিযোগ করেন, হাতিরঝিল থানা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আশরাফ উদ্দিন চৌধুরী অপুকে গত পরশু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাদাপোশাকধারী ব্যক্তিরা তুলে নেওয়ার পর থেকে তিনি নিখোঁজ রয়েছেন।
দুঃসহ পরিস্থিতির বর্ণনায় ভুক্তভোগীরা
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ভুক্তভোগী রাজবাড়ী জেলা মহিলা দলের নেত্রী সোনিয়া আক্তার বিএনপির সেমিনারে অংশ নিয়ে তাঁর সেই দুঃসহ পরিস্থিতির কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরকারের বিরুদ্ধে লিখেছিলাম। সে কারণে আমার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দিয়েছিল। আমাকে রাতে রাজবাড়ী থেকে তুলে নিয়ে কয়েক ঘণ্টা কোথায় রেখেছিল, তা আমি জানি না। আমার দুটি ছোট বাচ্চা আছে, কিন্তু কোনো মানবিকতা তারা দেখায়নি। তারা আমাকে তুলে নিয়ে ছিল।’
সোনিয়া আক্তার উল্লেখ করেন, ‘তাঁর বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসেছিল বলে তিনি আলোচিত হয়েছেন। কিন্তু তাঁর মতো অনেক ভুক্তভোগী আছেন, যাঁদের খবর কেউ জানে না।’
ডিজিটাল আইনের আরেক ভুক্তভোগী মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক সুলতানা আহমেদ। তিনি বলেন, ‘আমি শুধু সামাজিক মাধ্যমে বক্তব্য দিয়েছিলাম, আবেগ থেকে একটু কথা বলেছিলাম, সে জন্য আমাকে তুলে নিয়ে গেলো।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাকে র্যাব অফিসে নিয়ে একের পর এক ইন্টারোগেশন করেছে। তার বর্ণনা দিলে শিহরিত হয়ে উঠতে হয়। আমাকে রিমান্ডের পর জেলে পাঠানো হয়, সেখানে আমাকে কম্বল-বালিশটা পর্যন্ত দেয়া হয়নি। এই হচ্ছে আমাদের স্বাধীন দেশ।’
৫৩ দিন গুম থাকার পর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলায় জেল খাটতে হয় ফটো সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলকে। তিনি দৈনিক পক্ষকালের সস্পাদক। তিনি বলেন, ‘৫৩ দিন গুম হওয়াকালে আমি কিছুই বুঝতে পারিনি যে, কোথায় আছি,কেমন আছি, আমার চোখ বন্ধ ছিলো। আমি ক্রসফায়ারারে মুখোমুখি হয়েছি। অভিযোগ ছিলো, আমি প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে লিখেছি। হয়ত লিখেছি। এটা আমার অধিকার, সাংবিধানিক অধিকার। তাই বলে গুম করে দেওয়া হবে। জেল খাটতে হবে।’
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ১৭ মাস জেলে ছিলেন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি রুহুল আমিন গাজী। তিনি বলেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে রাষ্ট্রের মানুষের সমস্ত অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে। এই আইনের সমস্ত ধারাই খারাপ, নির্মম, নির্দয়, মানবাধিকার পরিপন্থি।’
‘এটা কোনো আইন নয়, এটা অস্ত্র’
সেমিনারে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট কোনো আইন নয়, এটা একটা অস্ত্র। ভিন্নমত দমন করতে এই অস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় টিকে থাকতে এসব কালো আইন করেছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, এখনই ঐক্যবদ্ধ না হলে এই সরকারকে হটানো যাবে না। এ সরকারকে সরানো এখনই সঠিক সময় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বিএনপির এই সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘এই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন আমাদের সংবিধান পরিপন্থি। এই ডিজিটাল আইন গণতন্ত্রের পরিপন্থি।
১০ ভাগের এক ভাগ তথ্যও প্রকাশ করা যাচ্ছে না
সেমিনারে অংশ নিয়ে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, সরকারের যখন নৈতিক জায়গা থাকে না, তখন তারা জোর জবরদস্তি করে ক্ষমতায় থাকতে এমন কালো আইন করেছে। ডিএসএসহ সব কালাকানুন বাতিলের দাবি জানান তিনি।
জাতীয় সংসদ অধিবেশনের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দৈনিক প্রথম আলো নিয়ে যে সব মন্তব্য করেছেন, তার কঠোর সমালোচনা করেন সাইফুল হক। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের জনপ্রিয় একটি পত্রিকার বিরুদ্ধে জাতীয় সংসদে বিষেধারাগার করলেন। গণমাধ্যমের কাছে যে তথ্য আসে তার ১০ ভাগের এক ভাগও প্রকাশ করা যাচ্ছে না। মন খুলে প্রাণ খুলে কথা বলার সুযোগ নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
গণ অধিকার পরিষদের আহ্বায়ক রেজা কিবরিয়া বলেন, একটা সরকারকে সবাই পছন্দ করবে না এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু নানা কালাকানুনের কারণে মানুষ এখন আর সত্য কথা বলতে পারছে না। জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) সভাপতি মোস্তফা জামান হায়দার বলেন, সভ্য দুনিয়ার কোথাও বাংলাদেশের মতো এমন অবস্থা নেই।
বিএনপির প্রচার সম্পাদক শহিদ উদ্দিন চৌধুরীর সঞ্চালনায় সেমিনারে আরও বক্তব্য দেন এনডিপির ফরিদুজ্জামান ফরহাদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাদা দলের আহ্বায়ক অধ্যাপক লুতফর রহমান। এতে আরও উপস্থিত ছিলেন, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান ও সেলিমা রহমান, আবদুল্লাহ আল নোমান, শাহজাহান ওমর, হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, কল্যাণ পার্টির সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের হাসনাত কাইয়ুম, গনসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকি, গণঅধিকার পরিষদের নুরুল হক, লেবার পার্টির মোস্তাফিজুর রহমান প্রমূখ।