দিনের ঠা ঠা রোদে ৮-১০ মিনিট থাকলেই গরমে যেন শরীর পুড়ে যাচ্ছে। শীতকালের মতো ঠোঁট ফেটে যাচ্ছে। এ ধরনের তাপমাত্রায় বেশিক্ষণ থাকলে যেখানে দর দর করে ঘাম ঝরার কথা, এবার কিন্তু তা হচ্ছে না। চিকিৎসক ও আবহাওয়াবিদেরা এবারের চৈত্রের এই ব্যতিক্রম গরম অনুভূতির জন্য বাতাসে আর্দ্রতা কম থাকাকে মূল কারণ বলছেন।
আবহাওয়াবিদেরা বলছেন, এখনো ঢাকাসহ দেশের বেশির ভাগ এলাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা গত তিন বছরের তুলনায় কমই আছে। গত বছর দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছিল এবারের মতোই, চুয়াডাঙ্গা ও রাজশাহীতে। সেখানে এই এপ্রিলের ২৪ ও ২৫ তারিখে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪১ ডিগ্রিতে উঠেছিল। আজ মঙ্গলবার এ বছরের এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছে চুয়াডাঙ্গায় ৩৯ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর রাজধানীসহ দেশের বেশির ভাগ এলাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৭ থেকে ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ছিল।
এ ধরনের তাপমাত্রায় গরম বেশি থাকবে, এটাই স্বাভাবিক বলে মনে করছেন আবহাওয়াবিদেরা। তবে তাপমাত্রার তুলনায় গরম বেশি অনুভূত হচ্ছে। বাতাসে আর্দ্রতা কম থাকাকে এর কারণ বলছেন তাঁরা। বাতাসে আর্দ্রতা কম থাকলে সাধারণত বাতাস শুষ্ক হয়ে ওঠে। সেই সঙ্গে তাপমাত্রা বেশি থাকলে শরীর থেকে তা পানি শুষে নেয়। ফলে শরীরে জ্বালাপোড়া করে ও ঠোঁট শুকিয়ে যায়।
এ ব্যাপারে আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, চৈত্রের এই সময়ে বাতাসে যে পরিমাণে আর্দ্রতা থাকে তিন-চার দিন ধরে তার চেয়ে অনেক কম আর্দ্রতা রয়েছে। যে কারণে গরম বেশি অনুভূত হচ্ছে। মাঝারি তাপমাত্রায় শরীর জ্বালাপোড়া করছে ও ঠোঁট শুকিয়ে যাচ্ছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে ইফতারের পর পানি বেশি পান ও রসালো ফল খেতে হবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের চর্ম রোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম ভূইয়াও একই কথা বলেছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বাতাসে আর্দ্রতা কমে যাওয়ার কারণে শুধু ঠোঁট ফাটা নয়, শরীরের চামড়াও শুকিয়ে যাচ্ছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের কাছে থাকা গত ৩০ বছরের এপ্রিল মাসের বাতাসে আর্দ্রতার হিসাব রয়েছে। তাতে দেখা গেছে, এপ্রিলে দেশের সব কটি জেলায় বাতাসের আর্দ্রতা ৭০ থেকে ৮২ শতাংশ পর্যন্ত থাকে। কিন্তু তিন দিন ধরে আর্দ্রতার পরিমাণ কমে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশে নেমে এসেছে। গতকাল সোমবার বাতাসের আর্দ্রতা ছিল ৩২ শতাংশ, আজ তা কিছুটা বেড়ে ৫১ শতাংশ হয়েছে। অথচ ঢাকায় এপ্রিলের গড় আর্দ্রতা থাকে ৭১ শতাংশ।
আর্দ্রতা কম থাকার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আবহাওয়াবিদেরা বলছেন, সাধারণত ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশের ঊর্ধ্বাকাশ দিয়ে যে বাতাস প্রবাহিত হয়, তা উত্তর থেকে পশ্চিম দিকে যায়। ফলে ওই বাতাস শুষ্ক থাকে ও আর্দ্রতা কম থাকে। যে কারণে শীতকালে মানুষের ঠোঁট ফাটে, ঘাম কম হয়।
আর মার্চ থেকে শুরু করে পুরো বর্ষাকাল পর্যন্ত বাতাস দক্ষিণ থেকে পশ্চিম দিকে যায়। সেই বাতাসের সঙ্গে বঙ্গোপসাগর থেকে প্রচুর জলীয় বাষ্প আসে। এতে বাতাসে আর্দ্রতা বেড়ে যায়। ফলে সামান্য তাপমাত্রা বাড়লেই মানুষ জলীয় বাষ্পের সংস্পর্শে এলে ঘাম ঝরা বেড়ে যায়। আর নিশ্বাসের সঙ্গে শরীরে আর্দ্রতাপূর্ণ বায়ু প্রবেশ করায় ঘাম ঝরার পরও শরীর খুব বেশি ক্লান্ত হয় না, জ্বালাপোড়া কম হয়।
এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও জলবায়ু গবেষক রাশেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘কয়েক যুগ ধরে আমরা দেখছি, বাংলাদেশের আবহাওয়াকে লা নিনা (প্রশান্ত মহাসাগরের ওপর তৈরি হওয়া উষ্ণ রেখা) ও এল নিনো (শীতল রেখা) ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করছে। এ বছর বাংলাদেশে লা নিনা এবং ভারত মহাসাগর দ্বিচক্র বা আইওডি সক্রিয় রয়েছে। বৈশ্বিক আবহাওয়ার ওই বিশেষ চক্র সক্রিয় থাকায় প্রশান্ত মহাসাগর থেকে ভারত মহাসাগর হয়ে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলজুড়ে বাতাসপ্রবাহের স্বাভাবিক গতি বদলে গেছে। যে কারণে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে এই সময়ে বাতাস পশ্চিম থেকে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত না হয়ে উত্তর থেকে পশ্চিমে প্রবাহিত হচ্ছে। এর ফলে এবার গরমের তীব্রতার ক্ষেত্রে এই ব্যতিক্রমী পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে।’