মো. মাসুদ রানা. সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধিঃ
সিরাজগঞ্জ জেলা বাস, মিনিবাস ও কোচ মালিক সমিতির বর্তমান কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে চলতি বছরের শুরুতেই। নিয়মানুযায়ী মেয়াদ শেষ হবার আগেই সাধারণ সভা, আয়-ব্যয়ের হিসাব দাখিল ও নির্বাচন পরিচালনা কমিটি করার কথা থাকলেও তা করা হয়নি। মেয়াদ শেষের পরে সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদকের অভিযোগের প্রেক্ষিতে শ্রম অধিদপ্তরের হস্তক্ষেপে নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরু হলেও তা আটকে আছে অদৃশ্য কারণে। মানা হচ্ছেনা নির্বাচন সংশ্লিষ্ট রাজশাহী বিভাগীয় শ্রম অধিদপ্তরের নির্দেশনাও।
সম্প্রতি সিরাজগঞ্জ জেলা বাস, মিনিবাস ও কোচ মালিক সমিতির একাধিক সদস্য ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান মনির সঙ্গে কথা বলে এবং তার দায়ের করা অভিযোগ ও বিভাগীয় শ্রম অধিদপ্তরের পত্র যাচাই-বাছাই করে এসব তথ্য জানা গেছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সিরাজগঞ্জ জেলা বাস, মিনিবাস ও কোচ মালিক সমিতি সরকারি নিবন্ধনকৃত (নিবন্ধন নং: রাজ-৭৫৩) একটি নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ ব্যবসায়ী সংগঠন। কেউ সিরাজগঞ্জ জেলার নাগরিক ও বাস গাড়ির মালিক হলেই নিয়মানুযায়ী এই সমিতির সদস্য হতে পারবেন। বর্তমানে নির্বাচন পরিচালনা কমিটি ও রেজিস্ট্রার অব ট্রেড ইউনিয়ন কর্তৃক অনুমোদিত সমিতির সদস্য সংখ্যা ৭০৭জন। এই সংগঠনের বাংলাদেশ সরকারের শ্রম মন্ত্রণালয়ের অধিনস্ত রেজিস্ট্রার অব ট্রেড ইউনিয়ন কর্তৃক অনুমোদিত একটি গঠনতন্ত্র আছে। এই গঠনতন্ত্রের বিধি অনুযায়ী সংগঠনের সকল সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে থাকে, যা বাধ্যতামুলক। গঠনতন্ত্রের বিধি অনুযায়ী প্রতি তিন বছর পরপর সমিতির সদস্য/ভোটারদের প্রত্যক্ষ ভোটে যে কমিটির নেতৃত্ব নির্বাচিত হয় তাদের পরবর্তী তিন বৎসরের মধ্যে পরবর্তী নির্বাচিত কমিটির নেতৃবৃন্দের নিকট সমিতির সাংগঠনিক দ্বায়িত্বভার হস্তান্তর করতে হয়। গঠনতন্ত্রের আরেক ধারায় উল্লেখ আছে, নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কমপক্ষে ত্রিশ (৩০) দিন পূর্বে সাধারণ সভার মাধ্যমে একটি নির্বাচন পরিচালনা কমিটি গঠন করতে হবে, যে নির্বাচন পরিচালনা কমিটি পরবর্তী (৪৫) দিনের মধ্যে নির্বাচন করবেন।
জানা যায়, গত ২০২১ সালের ৬ জানুযারী সিরাজগঞ্জ জেলা বাস, মিনিবাস ও কোচ মালিক সমিতির নির্বাচনে লিটন সরকার সভাপতি ও আতিকুর রহমান আতিক সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে ৮ জানুয়ারি দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। সেই হিসাবে চলতি বছরের গত ৭ই জানুয়ারী নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন নির্বাচিত কমিটির নিকট দায়িত্বভার হস্তান্তর করার কথা। কিন্তু বর্তমান কমিটি (মেয়াদ উত্তীর্ণ) তার ব্যবস্থা না করে কালক্ষেপণ করেই চলেছেন। এ অবস্থায় রেজিষ্ট্রার অব ট্রেড ইউনিয়ন থেকে একাধিকবার লিখিতভাবে নির্বাচনের তাগাদা দেওয়া সত্ত্বেও বর্তমান কমিটি নির্বাচন বিলম্বিত করতে থাকে। সর্বশেষ নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ হলেও নির্বাচন পরিচালনা কমিটি সেই তফসিল স্থগিত ঘোষণা করেন। নির্বাচিত কমিটির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ কার্যনির্বাহী কমিটির কোনরূপ সহযোগিতা না পাওয়ায় নির্বাচন পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যানও পদত্যাগ করেন।
এরপর এক সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য মো. ফারুক আহম্মদকে নির্বাচন পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যান বানিয়ে আাগামী ২ নভেম্বর নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ করে নির্বাচন পরিচালনা কমিটির নতুন এই চেয়ারম্যান বরাবর একটি আদেশ পত্র দেন রেজিস্ট্রার অব ট্রেড ইউনিয়নের পরিচালক মোহাম্মদ আমিনুল হক। কিন্তু সেই আদেশ অনুযায়ী গঠনতন্ত্রের নিয়ম মতে নির্বাচন পূর্ববর্তী যে কার্যক্রম থাকার কথা তা দেখা যাচ্ছেনা। ফলে আসন্ন নির্বাচন নিয়েও শুরু হয়েছে ধুম্রজাল। এবারও দেখা দিয়েছে নির্বাচনের অনিশ্চয়তা। এতে ক্ষোভ বিরাজ করছে মালিকদের মাঝে।
সিরাজগঞ্জ জেলা বাস, মিনি বাস ও কোচ মালিক সমিতির সদস্য ও সুরভি পরিবহনের মালিক মো. ইউনূস আলী বলেন, মালিক সমিতির সাধারণ সদস্যদের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হচ্ছেনা। তারা আমাদের ভোটাধিকার হরণ করছে। কমিটির মেয়াদ পার হয়ে আরও একবছর চললো তবুও আমরা আমাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারলাম না। আমাদের দাবি থাকবে অতিদ্রুত একটি সুন্দর নির্বাচনের আয়োজন করে আমাদের ভোটাধিকারের মধ্যে দিয়ে নতুন নেতৃত্ব আসুক। এর কোনো বিকল্প নেই বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
মালিক সমিতির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, বর্তমান কমিটির নেতৃবৃন্দ চাইলেই নির্বাচন দিতে পারেন। কিন্তু তারা ইচ্ছে করেই নির্বাচন আটকে রেখেছে। অনেকদিন আগেই এই কমিটির মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছে। এখন সাধারণ বাস মালিকরা চান পুনরায় একটি সুন্দর নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে নতুন নির্বাচিতরা দায়িত্বে আসুক।
এব্যাপারে সিরাজগঞ্জ জেলা বাস, মিনিবাস ও কোচ মালিক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. মনিরুজ্জামান মনি বলেন, তারা যেকোনভাবে নির্বাচন না দিয়ে এভাবেই ক্ষমতা ধরে রাখতে চায়। ট্রেড অব ইউনিয়নের নির্দেশনাও তারা মানেননা। আগামী মাসের (নভেম্বর-২০২৪) দুই তারিখে নির্বাচন করার জন্য ট্রেড অব ইউনিয়নের পরিচালক নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু সেই নির্বাচনও তারা করবেন না বলেই মনে হচ্ছে। করলে সাধারণ সভা থেকে শুরু করে নির্বাচনী কার্যক্রম দেখা যেত। এখন শুনছি বর্তমান নির্বাচন পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যানও নাকি পদত্যাগ করেছেন। এগুলো সবই নির্বাচন না করার জন্য করা হচ্ছে। তারা ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখতে চায়। এজন্যই নানা নীল নকশায় লিপ্ত রয়েছেন। তিনি আরও বলেন, সিরাজগঞ্জ জেলা বাস, মিনিবাসও কোচ মালিক সমিতি একটা বিশাল বড় ব্যবসায়ী সংগঠন। এখানে এক একটা বাসের মালিক লক্ষ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করে বাস কিনে সমিতির সদস্য হয়। কিন্তু কার্যনির্বাহী কামিটির পরিচালনার অদক্ষতার কারণে মালিকরা ব্যবসা না পেয়ে পথে বসার উপক্রম হয়েছে। ইতোমধ্যে অনেক মালিক ব্যবসা না পেয়ে অনেক টাকা লস দিয়ে বাস বিক্রি করে দিচ্ছে। সমিতির সদস্যদের দেওয়া কল্যাণ অনুদানের নামে প্রতিদিন যে টাকা লোক নিয়োগ দিয়ে আদায় করে তার কোনো হিসাবও দেয়না। আজ পর্যন্ত তারা সমিতির বিস্তারিত আয়-ব্যয়ের হিসাবও দেয়নি। তারা গত সাধারণ সভায় অপূর্ণ একটি হিসাব উপস্থাপন করলেও সেটাও ছিল অস্বাক্ষরিত, তবুও সভাপতি কর্তৃক সাধারণ সভার রেজুলেশনে সেটা অনুমোদিত দেখানো হয়। তিনি আরও বলেন, কোন খাত থেকে কত টাকা আয় হচ্ছে এবং কোন খাতে কত টাকা ব্যয় হচ্ছে তার বিস্তারিত জানার অধিকার সদস্যদের আছে। কিন্তু তারা সঠিকভাবে সেটাও জানাচ্ছেন না। এ বিষয়গুলো সঠিক তদন্ত করলে প্রতিদিনের আয়ের ও ব্যয়ের হিসাব পাওয়া যাবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
এব্যাপারে সিরাজগঞ্জ জেলা বাস, মিনিবাস ও কোচ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. আতিকুর রহমান আতিক বলেন, নির্বাচন দেওয়া ও নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সকল দায়িত্ব নির্বাচন পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যানের। তাই আগামী ২ তারিখে নির্বাচন হচ্ছে কিনা সেটাও তিনিই বলতে পারবেন। তবে শুনলাম গত ২০ তারিখে নাকি তিনিও পদত্যাগ করেছেন।
তাহলে কি নির্বাচন হচ্ছেনা বা বারবার কেন নির্বাচন পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যানরা পদত্যাগ করছেন এবং সার্বিক অবস্থা কি এমন প্রশ্নের উত্তরে আতিক বলেন, আপনি পারলে সভাপতির সঙ্গে একটু কথা বলেন, তিনিই বিস্তারিত বলতে পারবেন।
এব্যাপারে কথা বলার জন্য নির্বাচন পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যান মো. ফারুক আহম্মদের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। তবে নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য রওশন আলী ভুট্টু বলেন, আগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যান হোসেন মাষ্টার পদত্যাগ করার পর কমিটির বর্তমান সদস্যদের মতামতের ভিত্তিতে রাজশাহী রেজিষ্ট্রার ট্রেড ইউনিয়নের অফিসে আলোচনার ভিত্তিতে ফারুক আহম্মদকে পরবর্তী নির্বাচন পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত করে আগামী ২ নভেম্বর নির্বাচন তারিখ নির্ধারণ করে নির্দেশপত্র ইস্যু করা হয়। দুঃখজনক হলেও সত্য তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে নির্বাচনের কোন কার্যক্রমই শুরু করেননি। পরবর্তীতে তিনিও পদত্যাগ করেন। এর মধ্যে আমাদের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির অন্যান্য সদস্যদেরও আর নির্বাচন নিয়ে কোন আলোচনা হয়নি। এমতাবস্থায় কোনভাবেই আগামী ২ নভেম্বর নির্বাচন করা সম্ভব না।